
ছবি: সাহাদাত পারভেজ
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম গুরু। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে গত শনিবার সকালে ঢাকায় এসেছেন তিনি। ওই দিন সন্ধ্যায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়েরের বাড়িতে তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন হারুন আল রশীদ
বর্তমানে ভারতের যে শাস্ত্রীয় সংগীত, তাতে ঘরানাপ্রথা কতটা কার্যকর?
আগের দিনের ওস্তাদ-পণ্ডিতেরা নিজেদের ঘরের বিদ্যা অন্য ঘরে যেতে দিতে চাইতেন না। এই মানসিকতা সংগীতের বিস্তারকে সংকীর্ণ করেছে। তার চেয়ে বিদ্যা উন্মুক্ত থাকাই ভালো। যে যার মতো করে রপ্ত করে নিক। ভালো হলে শ্রোতারা নেবেন, খারাপ হলে নেবেন না।
তাহলে আপনি নিজেকে পাতিয়ালা ঘরানার শিল্পী বলে মনে করেন না?
না। আমি মনে করি না। ওস্তাদ মুনওয়ার আলী খান সাহেবের কাছে শিখেছি বলেই হয়তো গুণীজনেরা এটা বলে থাকেন। আমি তো গোয়ালিয়র ঘরানার পণ্ডিত নিবৃতিবুয়া সরনায়েকের কাছেও শিখেছি। তাই বলে কি আমি গোয়ালিয়র ঘরানার? আমি অনেকের কাছেই শিখেছি। আমার গায়কিতে তাঁদের সবারই প্রভাব আছে কমবেশি। রশিদ খানকে সবাই রামপুর সহসওয়ান ঘরানার বলে থাকেন। আসলে কি তাই? আমার মনে হয়, ওর গায়কিতে একসঙ্গে ওস্তাদ নিসার হুসেন খান, ওস্তাদ আমীর খান বা পণ্ডিত ভীমসেন যোশির মতো বেশ কয়েকজন শিল্পীকে খুঁজে পাওয়া যায়। আসলে রশিদ যে শিল্প তৈরি করেছে, সেটা তার একান্তই নিজস্ব।
আপনার সংগীতের শুরুটা কীভাবে করেছিলেন?
আমার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের শ্যামনগরে। কিন্তু আমার বাবা-মা ছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের। তাঁরা ১৯৩৩ সালে শরণার্থী হয়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে আমাদের পরিবারের এক বেলাও ঠিকমতো খাবার জুটত না। এত কষ্টের মাঝেও বাবা বলতেন, তাঁর ছেলেকে শিল্পী হতে হবে, দেশের এক নম্বর গায়ক হতে হবে। নইলে তিনি ধরে নেবেন, তাঁর ছেলে মারা গেছে। আমাকে বলতেন, ‘কুপুত্র থেকে নির্বংশ হওয়া ভালো।’ তাঁর কথায় কুপুত্র মানে গায়ক না হওয়া। তখন বাবা আমাদের বাড়িতে তাঁতের মেশিন বসিয়েছিলেন। সেই তাঁতের মাকুর শব্দ থেকে আমি তাল শিখেছি। মূলত বাবাই আমার প্রথম সংগীতগুরু।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রেরণাটা কে দিয়েছিলেন?
গ্র্যাজুয়েশন করার পর বাবার ইচ্ছে ছিল, ছেলে ফিজিক্স্ নিয়ে পড়বে। বাদ সাধলেন আমার গুরু পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। তিনি বাবাকে ডেকে বললেন, ‘অজয় গান নিয়ে পড়বে, অন্য কিছু নয়।’ তাঁর পরামর্শে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। গুরু যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা বিফলে যায়নি। কারণ তিনি সংগীতের সত্যদ্রষ্টা। আমি তাঁর কাছে শুধু গানই নয়, ৩০ বছর হারমোনিয়াম বাজানো শিখেছি। সাহিত্য কেন পড়তে হয়, গান কীভাবে লিখতে হয়—এর সবই তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। বোধ করি, সে জন্যই আমি বাবা-মায়ের চেয়েও গুরু পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকে বেশি মিস করি। তিনি যেভাবে শিখিয়েছেন, তার তুলনা হয় না।
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গে আপনার শুরু কত সালে?
স্কুলে পড়ার সময় আমি শুরুতে পান্নালাল সামন্ত এবং পরে কানাইদাস বৈরাগীর কাছে তালিম নিই। ১৯৬৮ সালের মার্চে গুরু জ্ঞানপ্রকাশের কাছে শিখতে শুরু করি। এরপর ৩৩-৩৪ বছরের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ। মাঝে শুধু ১৯৬৯ এবং ১৯৭০—দুই বছর তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। তিনি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তাঁর পরামর্শে আমি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান সাহেবের ছেলে ওস্তাদ মুনওয়ার আলী খানের কাছে শিখেছি।
সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে (এসআরএ) কত সাল থেকে আছেন?
এসআরএতে স্কলার হয়ে যোগ দিই ১৯৭৭ সালে। একটা সময় আমি সারা রাত জেগে সংগীতচর্চা করেছি। কারণ তখন রাগসংগীতে বাংলার তেমন কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। এটা আমাকে খুব পীড়া দিত। মনে হয়, আমি সেই দরজাটা খুলতে পেরেছি। এখন অনেক শিল্পীই আসছে আর যাচ্ছে। আমার চেলারাই খুব ভালো গান-বাজনা করছে। আমার কন্যা কৌশিকী চক্রবর্তী তো এখন নারী শিল্পীদের মধ্যে ভারতজুড়ে মহা ব্যস্ত একজন গাইয়ে।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে না—একটা সময়ে অনেকেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সেই আশঙ্কা কেটে গেছে?
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেবের ছেলে ওস্তাদ আলী আকবর খান, মঘুবাঈ কুর্দিকরের কন্যা কিশোরী আমোনকর, ওস্তাদ আল্লারাখা খানের ছেলে ওস্তাদ জাকির হুসেনকে তৈরি করে গেছেন। কিন্তু এভাবে গুনতে গেলে পাঁচ-ছয়টির বেশি দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। আলী আকবর খান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেবদের মতো জগদ্বিখ্যাত আরও অনেকেই কোনো উত্তরসূরি রেখে যেতে পারেননি। তখন মনে হয়েছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত একদিন হয়তো সৌন্দর্য হারাবে। কিন্তু সে ভয় কেটে গেছে। এর কারণ এক এসআরএ। এখান থেকে যে পরিমাণ শিল্পী তৈরি হচ্ছে, এরাই ভবিষ্যতে ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতকে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দেবে।
কিন্তু বলা হয়, সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা, প্রাতিষ্ঠানিক নয়।
অবশ্যই সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই বিদ্যা রপ্ত করা কঠিন। কারণ ওখানে সিলেবাসের পড়া পড়তে হয়। দশগুরু দশরকম পড়ান। কিন্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে একজন গুরুর সান্নিধ্যে না থাকতে পারলে কখনো সত্যিকারের গান শেখা হয় না। সে জন্যই এসআরএর সৃষ্টি। এখানে গুরু-শিষ্যপরম্পরায় গান শেখানো হয়। ওস্তাদ মশকুর আলী খান, পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী, ওস্তাদ রশিদ হোসেন খান এবং আমি, আমরা সবাই এসআরএর স্কলার। এদের সবার অবস্থান এখন ভারতজোড়া। আর রশিদ যেভাবে নিজেকে ছড়িয়েছে তা রীতিমতো গর্বের।
বাংলাদেশের সংগীত সম্পর্কে কতটা জানেন?
বাংলাদেশে অসাধারণ কিছু প্রতিভা আছে। তালিম পেলে এসব প্রতিভা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শ্রেষ্ঠ জায়গায় পৌঁছাতে পারবে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে যেভাবে শিল্পের প্রসারে কাজ করছে, এভাবে পাঁচ-সাত বছর চললে সংগীতে বাংলাদেশের পট পরিবর্তন হবে।
0 comments:
Post a Comment