Loading...

Pages

Sunday, June 5, 2011

সংস্কৃতি জগতে পরিবারতন্ত্র !

আমাদের সংস্কৃতির দু'টি প্রধান ঘরানা- মধ্য আর উচ্চবিত্ত মিলে নাগরিক ঘরানা আর প্রত্যন্ত বাংলার আবহমান লোকজ ঘরানা। উভয় ঘরানাতেই পরিবারতন্ত্রের নজির আছে। 

লোকজ ঘরানায় যেটা আছে সেটা হলো বংশ পরম্পরা। বাউলের ছেলে বা মেয়ে বাউল হচ্ছে। আবার একত্রে পরিবারের বিভিন্ন জন গান বাজনা ইত্যাদি করছেন। এখনকার শহর ও গ্রামে সমান জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজ তাঁর বাবার কাছে গান শিখে বাবার সাথে গাইতে গাইতে এখানে এসেছেন। লোকজ ধারার শিল্পীদের নাগরিক সমাজে আসার প্রবণতাটি সাম্প্রতিক। তাই সেই সিলসিলার পরিচিতির বলয় এখনো প্রথম প্রজন্মে সীমাবদ্ধ। 



আমি এ লেখায় তাই আমাদের নাগরিক সংস্কৃতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব তুলে ধরবো। 

আমাদের নাগরিক সংস্কৃতির সূচনা মূলত: রাজ দরবারে। রামায়ণ মহাভারতেও রাজ দরবারে সংস্কৃতি চর্চার বর্ণনা পাই। দেবরাজ ইন্দ্রের সভা সংস্কৃতির আদি পীটস্থান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বংশী তো সংগীতের চিরকালীণ প্রতীক। ভক্তি মার্গ সাধনায়ও সংগীতের স্থান অতি উচ্চে। ভক্তি গীতে মীরা বাঈ একটি সমীহ জাগানিয়া নাম। নৃত্যগীত পটিয়সী আম্রপালীর উপাখ্যান কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। 

রাজ দরবারের আভিজাত্যের কারণে সেই সব গান বা নাচ ধ্রুপদী ঘরানার সূচনা করেছে। সেই সব সংগীত বা নৃত্যই আজ উচ্চাঙ্গ সংগীত আর নৃত্যের আদি নিদর্শন। ঐতিহাসিক কাল পরম্পরায় তা প্রবাহিত হয়েছে। মিয়া তানসেন মল্লার রাগে বৃষ্টি নামিয়ে ফেলতেন এমত কিংবদন্তীই আজো প্রচলিত। বৈজু বাওয়ার সাথে তানসেনের দ্বৈরথও সমান কিংবদন্তী। এ নিয়ে বলিউডে একটি মশহুর চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। 

সম্রাট আকবরের রাজ সভার আমির খসরুর কীর্তি এখনো সংগীতে বিদ্যমান (তবলা-বায়া, নতুন সৃষ্ট বিভিন্ন রাগ)। 

এ সব পর্যায়ে পরিবারতন্ত্রের কথা জানা যায় না। আমাদের অঞ্চলের সংস্কৃতিতে পরিবারতন্ত্রের বয়স শতবর্ষের কিছু বেশী। সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্র মিলে পরিবারতন্ত্রের সব চেয়ে বড় দুটি নজির সৃষ্টি করেছে জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবার আর ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়ার শিব পুরের খাঁ পরিবার (সংগীতে)।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সামাজিক আন্দোলনে (ব্রাক্ষ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা) রত থাকলেও তাঁর পরের প্রজন্ম সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে সংস্কৃতিতে বিপুল ভূমিকা রেখেছে। সেই পরিবারের উজ্জ্বলতম জোতিষ্ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রায় একক হাতে তিনি তৈরী করেছেন নবসৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাংস্কৃতিক কাঠামো। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের আধুনিক চারুকলার অন্যতম প্রাণপুরুষ। রবীন্দ্রনাথের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী নাটকের পর চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। ইন্দিরা দেবীর স্বামী প্রমথ চৌধুরীর লেখনীর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। শর্মিলা ঠাকুর টালিগঞ্জ আর মুম্বাইতে সমান দাপটে রাজত্ব করেছেন। তাঁর পুত্র সাঈফ আলী খান অর কন্যা সোহা আলী খান এখনকার নামী তারকা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁদের কীর্তিগাঁথা রচনা করে গেছেন। 

শিবপুরের খাঁ পরিবারে সংগীত ঘরাণার সূচনা করেন সবদার হোসেন খাঁন (সদু খাঁ ওরফে সাধু খাঁ)। তাঁর পরিচিতি নিজ এলাকাতেই মূলত: সীমিত ছিলো। সদু খাঁর পাঁচ পুত্র তিন কন্যার মধ্যে তিন পুত্রই সংগীত জগতের তিন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক-ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁন আর ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁন। এঁরা সেতার, সরোদসহ নানা যন্ত্র সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। সৃষ্টি করেছেন বহু নতুন রাগ রাগিনী। আলাউদ্দিন খাঁন প্রতিষ্ঠিত মাইহার ব্যাণ্ড এখনো সংগীত পিপাসুদের মনোরঞ্জন করে চলেছে। আলাউদ্দিন খানের পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খান (মুক্তিযুদ্ধের সময় মেডিসন স্কোয়ারের সেই বিখ্যাত কনসার্টে অন্যতম আয়োজক ও অংশগ্রহণকারী) অনেক নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন পাশাপাশি পাশ্চাত্য জগতে আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীতকে জনপ্রিয় করে গেছেন। আলাউদ্দিনের কন্যা রওশন আরা (অন্নপূর্ণা) ও প্রতিভাময়ী সংগীতজ্ঞ ছিলেন। আপন শিষ্য সেতারগুরু রবিশঙ্করের কাছে তিনি কন্যা অন্নপূর্ণাকে বিয়েও দিয়েছিলেন। অন্নপূর্ণা নানা কারণে ( মোবারক হোসেন খানের লেখা বইতে তার বিবরণ আছে) প্রকাশ্যে সংগীত জগতে আসেননি। তবে অন্নপূর্ণার যোগ্য ছাত্র পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশী ইতোমধ্যেই কিংবদন্তী হয়ে গেছে। 

আয়েত আলী খাঁর ছেলে মোবারক হোসেন খানও আপন সংগীত, লেখালেখিসহ নানা অঙ্গনে আপন প্রতিভার ছাপ এখনো রেখে চলেছেন। খাঁন পরিবারের সদস্য ওস্তাদ তড়িৎ হোসেন খান, ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান, শেখ সাদী খান প্রমুখ আমাদের সংগীত জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের পরের প্রজন্মও তৈরী হচ্ছে সঙ্গীতে অবদান রাখার জন্য। মোবারক হোসেন খান-ফৌজিয়া খান দম্পতির কন্যা রিনাত ফৌজিয়া এর মধ্যেই উচাঙ্গ সংগীতের জগতে আলো ছড়াতে শুরু করেছেন।


ব্রাম্মনবাড়ীয়ার খাঁ ফ্যামিলীর আরেক পরিচিত নাম শেখ সাদী খান। যিনি গত তিন দশক ধরে অনেক সুন্দর সুন্দর গান (যেমনঃ হাজার মনের কাছে প্রশ্ন, আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, ডাকে পাখী খোল আঁখি, চন্দ্র সুর্য্য সবই আছে আগে আগের মত, একটা দোলনা যদি কাছে পেতাম, কাল সারারাত ছিল স্বপ্নের রাত, চাঁদে কলংক আছে যেমন, ও মানুষ যারে দাও ভালবাসা, ইচ্ছে করে তোমায় দেখে বলি,এ ধরনের প্রচুর গানের সুরস্রস্টা)

বংশ পরম্পার আরেকটি উজ্জ্বল নিদর্শন ময়মনসিংহের রায় পরিবার। উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী আমাদের পথিকৃত শিশু সাহিত্যিকদের এক জন। তাঁর পুত্র সুকুমার রায় আমাদের শিশু সাহিত্যের মুকুট হীন সম্রাট। সুকুমারের পুত্র সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র এবং কিশোর সাহিত্যের শ্রদ্ধেয় নাম এবং তাঁর পুত্র সন্দীপ রায় চলচ্চিত্রে অবদান রেখে চলেছেন।

কবি নজরুলের পুত্র সব্যসাচী ইসলাম আমাদের শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকার। অপর পুত্র অনিরুদ্ধ ছিলেন খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক। নজরুল পরিবারের এর পরের প্রজন্মের মিস্টি কাজী, খিলখিল কাজী নজরুল সংগীত সাধনায় রত আছেন। 

নজরুলের বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও লেখক। তাঁর চার কন্যা ও নয় পুত্রের মধ্যে অনেকেই নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা জোবায়দা মির্জা লেখালেখিতে খ্যাতি অর্জন করেন। আরেক কন্যা ড. সানজিদা খাতুন বিশিষ্ট অধ্যাপক, লেখক, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও সংগীত সংগঠক। তিনি কিংবদন্তী প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রাণভোমরা। অপর দুই কন্যা ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কাজী আনোয়ার হোসেন মাসুদ রানা আর সেবা প্রকাশনীর জন্য তরুনদের কাছে অতিপ্রিয় নাম। এক সময় কাজী আনোয়ার হোসেন খুব জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী ছিলেন। অপর পুত্রদের মধ্যে কাজী মাহবুব হোসেন, কাজী শাহনূর হোসেন, কাজী সারওয়ার হোসেন লেখোলেখা করেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রওনক হোসেন বিশিষ্ট ফটোসাংবাদিক। 

সেবা প্রকাশনীর কাজী আনোয়ার হোসেনের আরেকটি পরিচয় হল, এককালের জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী।একসময়ের জনপ্রিয় গান "রিক্সাওয়ালা বেচারা"সুতরাং ছবিতে আব্দুল আলীমের সাথে তার অসামান্য গান " বেলা বয়ে যায় মধুমতি গায়"- ক'জন ভূলতে পেরেছে।

0 comments:

Post a Comment

 
Design by Free WordPress Themes | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | cheap international calls